একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে জোট, তার নেতৃত্বে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে এজেন্ডাবিহীন সংলাপে যাওয়া বিএনপির জন্য ভুল ছিল বলে মনে করেন দলটির চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। পাশাপাশি ২০ দলীয় জোটের অন্যতম শরিক জামায়াত ছাড়ার আগে সিদ্ধান্ত নিতে গভীরভাবে পর্যালোচনা করার কথা বলেন তিনি। এ নিয়ে স্বল্প সময়ের চিন্তা না করে; দীর্ঘমেয়াদে চিন্তা করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন ২০ দলীয় জোটের শীর্ষ নেতা ও বিএনপি চেয়ারপারসন। দেশ ও জনগণের স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে কাউকে খুশি করে গোঁজামিল দিয়ে স্বল্প সময়ের মধ্যে ক্ষমতায় যাওয়ার পক্ষে নন সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী। জাতীয়তাবাদী শক্তি যে যেখানে আছে তাদের সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করে সামনে এগোনোর পক্ষে মাঠের বিরোধী দল হিসেবে পরিচিত বিএনপির এই শীর্ষ নেতা।
ঈদের দিন গত শনিবার রাতে গুলশানে চেয়ারপারসনের ভাড়াবাসা ফিরোজায় দলের স্থায়ী কমিটির নেতাদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময়কালে দেশের রাজনৈতিক নানা প্রেক্ষাপট নিয়ে আলোচনাকালে খালেদা জিয়া এসব কথা বলেন।
রাত সাড়ে ৮টা থেকে ১০টা পর্যন্ত নেতাদের সঙ্গে এ শুভেচ্ছা বিনিময় করেন খালেদা জিয়া। ‘ফিরোজায়’ প্রবেশের পর নেতারা পিপিই পরে দোতলায় ড্রয়িং রুমে বসেন। সেখানেই এ শুভেচ্ছা বিনিময় হয়। এ সময় ছিলেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার, মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বরচন্দ্র রায়, নজরুল ইসলাম খান, সেলিমা রহমান ও ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু।
এর আগে গত ২৫ মার্চ সরকারের নির্বাহী আদেশে ৬ মাসের সাজা স্থগিত করে মুক্ত হওয়ার পর প্রথম গত ২৫ মে ঈদুল ফিতরের দিন স্থায়ী কমিটির সদস্যদের খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছিল।
ফিরোজার নিরাপত্তাকর্মীদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, সকালে ঈদের নামাজের পর বোন সেলিমা ইসলাম ও ছোট ভাই শামীম ইস্কান্দার ও তার স্ত্রী কানিজ ফাতিমা বাসায় আসেন। দুপুরের খাবার বোনকে নিয়ে খালেদা জিয়া খেয়েছেন। খালেদা জিয়া মুক্ত হয়ে ফিরোজায় আসার পর থেকে তার কয়েকজন স্বজন ছাড়া প্রবেশাধিকারের ব্যাপারে কঠোর কড়াকড়ি রয়েছে।
ঈদুল আজহার শুভেচ্ছা বিনিময় শেষে ফিরোজা থেকে বেরিয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম সাংবাদিকদের প্রশ্নে বলেন, আমরা কথা বলেছি, ঈদের দিনে যেসব কথা বলা হয়। এতদিন ধরে আমরা একসঙ্গে কাজ করছি, সবার সুখ-দুঃখের কথাবার্তা আছে। তিনি আরও বলেন, আপনারা জানেন ইতোমধ্যে আমাদের দলেরই অনেকে নিবেদিতপ্রাণ নেতাকর্মী তারা করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। তাদের সম্পর্কে কথা হয়েছে, তাদের পরিবার পরিজনকে নিয়ে কথা হয়েছে। এর মধ্যে অনেকের ছেলেমেয়ের বিয়ে হয়েছে, অনেকে চলে গেছেন। সব কিছু মিলিয়ে বলা যেতে পারে সুখ-দুঃখের আলাপ হয়েছে। দল যেন সঠিকভাবে চলতে পারে তা নিয়েও দলের চেয়ারপারসনের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে বলে জানান বিএনপি মহাসচিব।
স্থায়ী কমিটির নেতা ও দলীয় সূত্রে জানা গেছে, খালেদা জিয়ার সঙ্গে স্থায়ী কমিটির নেতাদের করোনা ভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতি, বন্যা পরিস্থিতির বাইরেও দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। বিশেষ করে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন, প্রধামন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সংলাপ, জামায়াতসহ গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে কথা বলেছেন খালেদা জিয়া।
আলোচনার এক পর্যায়ে খালেদা জিয়া নেতাদের উদ্দেশে বলেন, ‘আপনারা কেন ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে জোট করতে গেলেন? কেন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সংলাপে গেলেন? আবার গেছেন, আগে কেন এজেন্ডা ঠিক করলেন না? আপনারা ড. কামাল হোসেনকে জাতীয় নেতা বানালেন। তিনি কবে জাতীয় নেতা ছিলেন? তিনি গণতন্ত্র পুনর্প্রতিষ্ঠার জন্য কী করেছেন? তিনি তো জাতীয়তাবাদী শক্তির কেউ নন। তার সঙ্গে তো আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব, আদর্শিক নয়। তিনি তো সব সময় তার নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের কথাই বলেন। ড. কামাল যদি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন করতেন তা হলে তো এই সরকার থাকত না।
এ সময় জোট গঠন ও নির্বাচনে যাওয়ার পক্ষে জোরালো ভূমিকা রাখা তিন নেতা নিজ নিজ অবস্থান ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে খালেদা জিয়ার সামনে হালকা তর্কে জড়িয়ে পড়েন। ওই তিন নেতার উদ্দেশে অপর এক নেতা বলেন, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে স্থায়ী কমিটির অর্ধেক নেতা শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনে যাওয়ার বিপক্ষে ছিলেন। ওই তিন নেতার মধ্যে একজন বলে ওঠেন, এটা ছিল সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত। জবাবে স্থায়ী কমিটির ওই নেতা বলেন, আপনারা আমাদের ফাঁদে ফেলেছেন।
সম্প্রতি স্থায়ী কমিটির বৈঠকে জামায়াত ছাড়ার প্রশ্নে অধিকাংশ নেতা একমত পোষণ করেন। এ প্রসঙ্গটি খালেদা জিয়ার সামনে তুলে ধরা হয়। এ প্রসঙ্গে বিএনপি চেয়ারপারসন বলেন, জামায়াত ছাড়ার বিষয়টি নিয়ে আরও আলোচনার প্রয়োজন আছে। স্বল্প সময়ের চিন্তা না করে দীর্ঘমেয়াদি চিন্তা করতে হবে।
এ সময় তিনি দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নাজুক হওয়ার আশঙ্কাও প্রকাশ করেছেন। নেতাদের উদ্দেশে তিনি বলেন, আপনাদের মনে রাখতে হবে, বিএনপি হচ্ছে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী রাজনৈতিক দল। এই দলের কাছে দেশের স্বার্থ ও জনগণ সবার আগে। দেশ ও জনগণের স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে এমপি, মন্ত্রী অথবা ক্ষমতায় গিয়ে কী হবে। দেশ ও জনগণের স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে কাউকে খুশি করে গোঁজামিল দিয়ে ক্ষমতায় যাওয়ার কোনো চিন্তা করাও ঠিক না।
শুভেচ্ছা বিনিময়ের শেষ পর্যায়ে এসে এক নেতা খালেদা জিয়ার কাছে জানতে চান, আমরা শুনতে পাচ্ছি, নির্বাচনের সময় এ নিয়ে আমাদের দলের অনেক নেতার সঙ্গে প্রতিবেশী দেশটির বিভিন্ন লোকজনের সঙ্গে কথাও হয়েছে। তা হচ্ছে, জোট থেকে জামায়াত এবং দলের শীর্ষ পদ থেকে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানকে বাদ দিলেই বিএনপিকে তারা (প্রতিবেশী দেশ) ক্ষমতায় নেবে। এখন ধরলাম আমরা জোট থেকে জামায়াতকে বাদ দেব, এর পর যদি মাইনাস টু মানে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানকে বাদ দেওয়ার কথা বলে তখন কী হবে।
ওই নেতা আরও বলেন, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে করা মামলায় আপনি দুই বছর কারাগারে ছিলেন। এ সময় দেশের বড় একটি জনগোষ্ঠী আপনার ওপর যে অন্যায় হয়েছে তার বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। আমরা আপনাকে জেলে রেখে এসে নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিয়েছি। এজন্য দেশের রিকশাচালকরাও আমাদের দেখে টিপ্পনী কাটে। আপনি জাতীয়তাবাদী শক্তির প্রতীক। আপনি এভাবে নিজেকে আইসোলেশনে রাখবেন না। কারণ দেশের মানুষ আপনাকে ফিল করলেও দলের নেতাকর্মীরা কিন্তু আগের মতো ফিল করছে না। আপনি এখন থেকে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান অথবা দলের যে কোনো পর্যায়ের নেতাদের মাধ্যমে দল পরিচালনায় আপনার আইডিয়া শেয়ার করার অনুরোধ করছি।
ওই নেতা বলেন, আপনি কারাগারে যাওয়ার পর যত সিদ্ধান্ত বিএনপি নিয়েছে প্রত্যেকটি সিদ্ধান্ত সরকারের পক্ষে গেছে। এখন আমাদের দেশের মানুষ সাধারণ নেতাকর্মীরা সবাই সন্দেহ করে, আমাদের সরকার নিয়ন্ত্রণ করে কিনা। খালেদা জিয়া ওই নেতার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনলেও কোনো জবাব না দিয়ে মুচকি হাসি দিয়ে শুভেচ্ছা বিনিময় অনুষ্ঠান শেষ করেন।
বৈঠক বিষয়ে উপস্থিত সাংবাদিকদের মির্জা ফখরুল আরও বলেন, দল যেন সঠিকভাবে চলতে পারে তা নিয়েও দলের চেয়ারপারসনের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। দেশে বর্তমানে করোনা পরিস্থিতি, বন্যা পরিস্থিতি ও রাজনৈতিক যে অবস্থা- এটা তো স্বাভাবিক নয়। এটি অস্বাভাবিক পরিস্থিতি। এ পরিস্থিতিতে উনার বিরুদ্ধে, দেশের সব মানুষের বিরুদ্ধে বিশেষ করে যারা ভিন্নমত পোষণ করেছেন তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন রকম মামলা-মোকদ্দমা, জেল-জুলুম চলছে। এর মধ্যে তিনি দলকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে বলেছেন। তিনি আরও বলেন, করোনা ভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতিতে জনগণের পাশে দাঁড়ানো, বন্যা পরবর্তী ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের পুনর্বাসন ও ত্রাণ নিয়ে পাশে দাঁড়াতে যতটুকু সম্ভব নেতাকর্মীদের বলেছেন।
খালেদা জিয়ার অসুস্থতার কথা তুলে ধরে মির্জা ফখরুল বলেন, ম্যাডাম এতই অসুস্থ নিজেও বাসার নিচে নামতে পারেন না, হাঁটতেও পারেন না। তার এখনো খাওয়াদাওয়ায় সমস্যা, খেতেও সমস্যা হচ্ছে। আসলে ম্যাডামের উন্নত চিকিৎসা প্রয়োজন। এখানে হাসপাতালেও যাওয়া যাচ্ছে না। সব মিলিয়ে তার শারীরিক অবস্থা ভালো নেই। খালেদা জিয়ার নির্বাহী আদেশে মুক্তির ৬ মাসের সময়সীমা প্রায় কাছাকাছি চলে এসেছে- পরবর্তী কর্মকা- সম্পর্কে জানতে চাইলে বিএনপি মহাসচিব বলেন, এ বিষয়টা নিয়ে এখনো বিস্তারিত আলোচনা হয়নি। সময় এলে আলোচনা হবে।
Leave a Reply